বিশ্ববিদ্যালয়ে পডুয়া শিক্ষার্থীদের চোখে আগামীর জন্মভূমি
রোহিঙ্গা-মাদক নয়, উন্নয়নেই তরুণদের নতুন প্রতিজ্ঞা

রহমত উল্লাহ::
সমুদ্র, পাহাড় আর নদীঘেরা উখিয়া-টেকনাফ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের মনোরম অঞ্চল। কিন্তু এই সীমান্ত আজ জর্জরিত নানা সংকটে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, মাদক ব্যবসা, বেকারত্ব, শিক্ষার ঘাটতি ও দারিদ্র্য যেন এক অদৃশ্য জালে বেঁধে রেখেছে এ জনপদকে। নারীরা আজও লড়ছেন নিরাপত্তা আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে।
তবু আশার আলো নিভে যায়নি। চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন তরুণ শিক্ষার্থী যাদের জন্ম ও শেকড় এই উর্বর সীমান্ত মাটিতে তারা আজ নতুন সময়ের কণ্ঠস্বর। তাদের স্বপ্ন, প্রতিশ্রারুতির জনীতি নয়; বাস্তব পদক্ষেপ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই উখিয়া-টেকনাফ হতে পারে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নারী উন্নয়নের মডেল অঞ্চল হিসেবে দেখতে চায়।
‘শাহপরীরদ্বীপকে সম্ভাবনার দ্বীপে রূপ দিতে চাই”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তুহিন উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের শাহপরীরদ্বীপ আজ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজের টানাপোড়েনে ভুগছে। তরুণ প্রজন্ম আসক্তি ও দিকহীনতায় হারাচ্ছে সম্ভাবনা। এই বাস্তবতায় প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যিনি তরুণদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি গড়বেন। শাহপরীরদ্বীপের প্রায় ৪০ হাজার মানুষের একটাই দাবি একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। এখন সময় এসেছে সচেতন সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগে এই দ্বীপকে সম্ভাবনার দ্বীপে রূপান্তর করার।
‘রোহিঙ্গা ও মাদকের ছায়া থেকে মুক্তি চাই’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইয়াছিন আরফাত সাকিব বলেন, “উখিয়া-টেকনাফের মানুষ আজ রোহিঙ্গা ও মাদকের দ্বৈত সংকটে ক্লান্ত। তরুণদের আসক্তি, বেকারত্ব ও অপরাধ বাড়ছে। এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার দূরদর্শী নেতৃত্ব যিনি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, মাদকবিরোধী উদ্যোগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।”
‘নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলতুননেছা ফৌজিয়া বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট, মাদক ও দারিদ্র্যের ভার নারীদের জীবনকে ভারী করে তুলেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানে তারা এখনও পিছিয়ে। আমরা এমন নেতৃত্ব চাই, যিনি নারীর অধিকার রক্ষা, উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। উখিয়া-টেকনাফের নারীরা উন্নয়নের অংশীদার হবে এই প্রত্যাশাই আমাদের।”
‘শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, চাই বাস্তব পরিবর্তন”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ কাইফ বলেন, “উখিয়া-টেকনাফের মানুষ প্রতিদিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঁচে। অবকাঠামো, কর্মসংস্থান ও ন্যায়বিচারের অভাব স্পষ্ট। আমরা এমন প্রার্থী চাই, যিনি কথায় নয়, কাজে পরিবর্তন আনবেন। শাহপরীরদ্বীপ করিডোর ও বন্দর পুনরায় চালু করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন এবং গুম-খুনের বিচার নিশ্চিত করবেন।
“স্বচ্ছ নেতৃত্ব পেলে এ অঞ্চল আবার জেগে উঠবে”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নওশাদ আকবর বলেন,“শুধু আইন-শৃঙ্খলা নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। মাদক নিয়ন্ত্রণে আধুনিক নজরদারি ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি। স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব পেলে এ অঞ্চল আবার শান্ত ও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে।”
“নারীর শিক্ষায় বিনিয়োগ জরুরি”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রিফাত কবির বৃষ্টি বলেন,“দারিদ্র্যের কারণে অনেক মেয়ে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। বাল্যবিবাহের ঝুঁকি বাড়ছে। তাই নারীর শিক্ষায় বিনিয়োগ, দক্ষতা উন্নয়ন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।”
“তরুণদের কর্মসংস্থানই হবে পরিবর্তনের চাবিকাঠি”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনির উল্লাহ বলেন, “উখিয়া-টেকনাফের শিক্ষিত তরুণদের সবচেয়ে বড় সংকট কর্মসংস্থান। স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা এমন নেতৃত্ব চাই, যিনি সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বাস্তব সমস্যা সমাধান করবেন। একটি মাদকমুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও উন্নয়নমুখী সমাজ গড়বেন।”
‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিখাত আনজুম আহমেদ বলেন, “আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যেখানে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে। তরুণ প্রজন্ম চায় সহিংসতামুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, কর্মসংস্থান ও সুশাসনের নিশ্চয়তা।”
‘উন্নয়নে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিতে হবে’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রহমত উল্লাহ বলেন, “উখিয়া ও টেকনাফ আজ বেকারত্ব, অপহরণ ও অপরাধে বিপর্যস্ত। জনগণ এমন নেতৃত্ব চায়, যিনি স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন, সীমান্ত ও পর্যটন উন্নয়ন এবং স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করবেন।”
উখিয়া-টেকনাফের তরুণরা আজ অন্ধকার নয়, আলোর স্বপ্ন দেখে। রোহিঙ্গা সংকট, মাদক ও বেকারত্বের ছায়া পেরিয়ে তারা চায় শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নারী-পুরুষের সমতা ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব। তাদের কণ্ঠে ভেসে আসে পরিবর্তনের আহ্বান-বাস্তব উদ্যোগেই গড়ে উঠবে মাদকমুক্ত, শিক্ষাবান্ধব ও শান্তির উখিয়া-টেকনাফ। এই তরুণ প্রজন্মই পারে সীমান্তের এই ভূমিকে পরিণত করতে বাংলাদেশের “সীমান্তের স্বপ্নভূমি”তে।


পাঠকের মতামত